ফ্রিল্যান্সার থেকে সফল উদ্যোক্তা মেহেরপুরের হিরোক, দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত

মর্তুজা ফারুক রুপক, মেহেরপুর থেকে গল্পের শুরুটা ২০০৯ সালের। ফ্রিল্যান্সিং করে প্রথম ৪ ডলার উপার্জন (বাংলাদেশি ঢাকায় প্রায় সাড়ে তিনশ)। ২০০৬ সাল থেকে নাগাতার চেষ্টায় অনলাইনে কাজ করে। টাকার মুখ দেখেন ২০০৯ সালে। এরপর থেকে আর ফিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বলছিলাম মেহেরপুরের প্রত্যন্ত এক অজপাড়াগায়ের ছেলে মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হিরোকের কথা। মানুষ তাকে ইন্টারনেট হিরোক বলেই বেশি চেনে। মেহেরপুর সদর উপজেলার চাঁদবিল গ্রামের মুন্সি আবুল খায়েরের ছেলে মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হিরোক । শৈশব তার গ্রামেই কেটেছে। পরে ঢাকার নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ শেষ করেছেন ২০১৩ সালে।

কম্পিউটার, ইন্টারনেটের প্রতি বেশ ঝোঁক ছিল হিরোকের। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ওয়েবডিজাইন, ডাটা এন্ট্রি- এসব কাজ করার চেষ্টা করতেন ইন্টারনেটে। পরে আপওয়ার্ক ও ফাইবার মার্কেটে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগতেন। ৩ বছর চেষ্টার পর জার্মানির একটি কোম্পানির মাত্র ৪ ডলারের কাজ পান হিরোক। কাজ সম্পন্ন করলে আরো ১৬ ডলারের কাজ পান তিনি। কোনো রকম প্রশিক্ষণ বা গুরু ছাড়াই নিজ প্রচেষ্টায় ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ৪ বছরেই সফল ফ্রিল্যান্সার বনে যান তিনি। আর হতে থাকে মাসে লাখ টাকারও বেশি। পরে এমবিএ শেষ করে ২০১৩ সালে নিজ মাতৃভূমি মেহেরপুরের চাঁদবিলে চলে আসেন। যেখানে মানুষ ইন্টারনেট কী সেটাই ঠিকঠাক জানত না সেখানে গড়ে তোলেন 'মুন্সি আইটি' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। শুরু করেন বিনামূল্যে এলাকার যুবকদের অনলাইনে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেয়া।

হিরোকের পরিচালনায় মুন্সি আইটিতে ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিনামূল্যে ২ হাজার বেকার যুবককে ফ্রিল্যান্সার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রথম দিকে গ্রামের মানুষকে বোঝাতে হয়েছে, তাকে দেখতে বেকার মনে হলেও তিনি কাজ করছেন। ঘরে বসেই পৃথিবীর অন্য দেশের কাজ করতে পারেন। কম্পিউটারে থেকে। চাঁদবিলের মতো এক পল্লী গাঁয়ে থেকে। কীভাবে টাকা বের হয় এ ধরনের মজার প্রশ্নেরও উত্তর বুঝিয়ে দিতে হয়েছে তাকে। হিরোকের কাছে প্রশ্নগুলো কখনো মনে হতো খুব মজার, কখনো হতাশারও। প্রথাগত ধারণার বাইরে থেকে, নতুন কিছু করার ইচ্ছা থাকে অনেকেরই। কেউ সুযোগ পায়, কেউ পায় না। অনেকে কপালের ভাগ্যটা নিজ হাতে লেখেন। এমনই একজন মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত হিরোক। নিজের ভাগ্য বদলেছেন, পাশাপাশি অন্যের জন্য বয়ে এনেছেন সৌভাগ্যের বার্তা। বর্তমানে শতাধিক যুবক মুন্সি আইটি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনলাইনে কাজ করে আলিশান জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে মুন্সি আইটিতে কাজ করছেন ১ থ্রিল্যান্সার হিরোকের আয় মানে ১০ লাখেরও বেশি।

শুরুর দিকের বিপত্তির কথা নিজের মুখেই বললেন হিরো, গ্রামে পরিচিতজনরা প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, কী করো? পেশা কী? সেটা বোঝানো আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। কারণ তরুণ সমাজ ছাড়া অনেকের কাছে আউটসোর্সিং শব্দটি একেবারে নতুন। আর আমার জন্য আরো কঠিন ছিল চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে কাজ করা। অনেকেই ভারত, আমি বেকার বসে আছি। একটা সময় আমি প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতাম। বাইরে বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ থাকলে এড়িয়ে যেতাম। বাড়তি মনোযোগ দিতে থাকলাম আমার কাজের প্রতি। কারণ কাজই হলো সব প্রশ্নের উত্তর।

কাজটা নিজের আগ্রহেই শিখতেন হিরোক। প্রথমে এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) দিয়ে ফ্রিল্যাশিং ক্যারিয়ার শুরু করি। শুরুর দিকে কাজ করতে অনেক সময় লাগত। চেষ্টা করতাম ধীরে ধীরে কাজটা শেষ করতে। পরে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, আর্টিকেল রাইটিং, ই-মেইল মার্কেটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজগুলো করতে থাকি। এরই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে অর্থ আসতে থাকে।

হিরোক আরো বলেন, যে কোনো কাজে দক্ষতা, মেধা, পরিশ্রমের বাইরে আরো একটি গুণ থাকা জরুরি। তা হলো ধৈর্য। আউটসোর্সিং কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। সৃষ্টিশীল প্রায় প্রতিটি কাজ এখানে করা সম্ভব। এর মাধ্যমে দেশের যে কোনো জায়গায় বসে কাজ করা সম্ভব। আমি বলব, বেকার বা যুবকদের হতাশায় না থেকে এ ধরনের কাজে যুক্ত হওয়া। কারণ আধুনিক বিশ্ব ক্রমশ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। সুতরাং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বদলাতে হবে আমাদের ভাগ্য। এটা সত্যি যে, কিছু তুমা ফ্রিল্যান্সিং কোম্পানির কারণে অনেকেরই এ সম্পর্কে কিছুটা নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে। কিন্তু একটু সাবধান হলে ফ্রিল্যান্সিংকে সহজেই পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব।

এ ব্যাপারে মেহেরপুর জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি তোজাম্মেল আযম বলেন, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য এখনো মেহেরপুর জেলার চাঁদবিল গ্রামের মুন্সি জাহাঙ্গীর জিন্নাত কাজ করে চলেছেন নিরলসভাবে। তিনি স্বপ্ন দেখেন ফ্রিল্যান্সিং দিয়ে সমাজকে আলোকিত করবেন। আমরাও চাই, কেবল রাজধানীর মোহে পড়ে না থেকে শিক্ষিত যুবকরা হিরোকের মতো ছড়িয়ে পড়বেন গ্রাম থেকে গ্রামে।

বুধবার, ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯


কোন মন্তব্য নেই:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.