ফ্রিল্যান্সিংয়ে হিরোকের অনন্য দৃষ্টান্ত, দৈনিক বাংলা পত্রিকাতে প্রকাশিত
মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, গ্রামে বসে তিনি ডলার আয় করছেন। প্রায় তিন হাজার তরুণ-তরুণীকে বিনা মূল্যে ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়েছেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪০ জন ফ্রিল্যান্সার তার সঙ্গে কাজ করছেন। মেহেরপুরের সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের চাঁদবিল নামে নিভৃত গ্রামে বসেই তিনি আজ একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। সৃষ্টি করেছেন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। মার্কেটিংয়ে এমবিএ করা সফল এই ফ্রিল্যান্সারের নাম মুন্সী জাহাঙ্গীর জিন্নাত। এলাকায় 'হিরোক' নামে তার পরিচিতি।
শুরুটা তার মোটেও ভালো ছিল না। পড়তে ছেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু অভিভাবকের সম্মতি মেলেনি। তারা বিবিএতে ভর্তি করে দেন। ছোটবেলা থেকেই তার ইলেট্রনিক জিনিসের প্রতি আগ্রহ ছিল। নষ্ট ইলেকট্রনিক পণ্য সারাতে চেষ্টা করতেন। নিজ চেষ্টায় ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শিখেছেন। কিন্তু সেখান থেকে আয়ের তেমন সুযোগ ছিল না।
কীভাবে ইন্টারনেট থেকে আয় করা যায়, এই চেষ্টায় কেটে যায় আরও দুটি বছর। ২০০৬ সাল থেকে চেষ্টা শুরু করে ২০০৯ সালে গিয়ে তিনি আয়ের মুখ দেখেন। ওডেস্কে জার্মানির একটা ক্লায়েন্টের ৪ ডলারের প্রজেক্ট পান হিরোক। প্রথম কাজে তার আয় হয় ১৬০০ টাকা। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে আরও কিছু প্রজেক্টে কাজের সুযোগ পান। ২০১০ সাল থেকে তিনি গ্রামে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করছেন। ফ্রিল্যান্সিং পেশাটিকে তিনি উপভোগ করেন। এতে স্বাধীনতা অনেক। হিরোক বলেন, 'ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ শেখা বেশ কঠিন। শুরুর দিকে অনেক ঝামেলা নিতে হয়। কিন্তু পরে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়।'
গ্রামে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ইন্টারনেট স্পিড খুব ধীরগতির ছিল। সে সময় ইন্টারনেটের খরচ কুলিয়ে ওঠা কঠিন ছিল। এ ছাড়া আরেকটি সমস্যা ছিল সামাজিক মর্যাদা। 'সারাক্ষণ বাসায় বসে করো কী? এটা কোনো চাকরি হলো?” মানুষের এমন কথাও শুনেছেন তিনি। কিন্তু নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসার কারণে এসব কোনো কিছুই জিন্নাতকে রুখতে পারেনি। মাত্র অল্প কয়েক দিনেই তার ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা মানুষ জেনে যান। তরুণরা বাসায় এসে ভিড় জমান। পরে বাসার পাশে থাকা আমবাগানে বসে এসইওর ট্রেনিং দেয়া শুরু করেন হিরোক। দিন দিন ছাত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে ২০১৩ সালের দিকে অফিস খোলেন। নাম দেন ‘ইউনিক সফট বিডি', যেখানে কাজের পাশাপাশি বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
২০১৫ সালের শেষের দিকে ইউনিক সফট বিডি থেকে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান জন্ম নেয়। যারা কাজ করে তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম 'অবয়ব’। প্রশিক্ষণ অংশটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয় এবং নাম দেয়া হয় ‘অল্টারনেটিভ স্কুল'। ইউনিক সফট বিডি থেকে সামাজিক কাজগুলো করা হতো। হিরোক ২০১৬ সালে সার্ভারমোর নামে হোষ্টিং ব্যবসা চালু করেন। ২০১৯ সালে ইউনিক এন্টারপ্রাইজ চালু করা হয়, যেখানে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসা চলছে।
হিরোক জানান, ২০২০ সালে অবয়বের নাম পরিবর্তন করে 'মুন্সী আইটি' (munshiit.com) করা হয়। ২০২০ সালে সার্ভারমোর নাম হয় দেশি হোস্টিং (deshihosting.com)। ইউনিক সফট বিডিকে নাম পরিবর্তন করে ২০২০ মুন্সী গ্রুপ (munshigroup.org) করা হয়। দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণে হিরোকের প্রতিষ্ঠান আজ বহু শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়েছে। হিরোক বর্তমানে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট এবং ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করেন। তার ক্লায়েন্টের মধ্যে আমেরিকান বেশি। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা, জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের ক্লায়েন্টও আছেন।
বেকারদের জন্য কাজ করতে চান হিরোক । বেকারদের বিনা মূল্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকেন হিরোক। তিনি জানান, ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রয় ৩০০০ বেকার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার কাছে কাজ শিখে এখন অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। হিরোকের 'মুন্সী আইটি'তে বর্তমানে ১২ জন কর্মরত আছেন। এ ছাড়া রাশিয়া, জার্মানি, আমেরিকা, ফিলিপাইন এবং ভারতে কাজ করছেন আরও অনেকে। সব মিলিয়ে ৪০ জনের মতো হবে বলে তিনি জানান।
ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে হিরোক বলেন, "ফ্রিল্যান্সিংয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কাজ শেখা এবং কাজের অভিজ্ঞতা তৈরি করা। সফল হয়েছি বলে এমন না যে আমি আর কাজ শিখি না। আমাকে প্রতিনিয়ত কাজ শিখতে হয়। নতুন কিছু এলে সেটাও শিখতে হয়। নিজেকে আপডেট করতে হয়। সময়ও অনেক মূল্যবান বিষয়। ক্লায়েন্টের মিটিং টাইম মনে রাখতে হয়। সময়মতো কাজ জমা দিতে হয়। কাজে সমস্যা হলে আগে থেকেই ক্লায়েন্টকে জানাতে হয়। দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করতে হয়।'
যেখানে অধিকাংশ তরুণ শহরে থাকতে পছন্দ করেন, সেখানে মুন্সী জাহাঙ্গীর জিন্নাত গ্রামে গিয়ে থাকছেন। কারণ, জানতে চাইলে তিনি বলেন, শহর ছেড়ে দেয়াটা আমার ব্যক্তিগত চাহিদা ছিল। ঢাকা শহর আমায় টানত না, শহরের প্রতিযোগিতা ভালো লাগত না। আমি জীবনকে সহজ করতে চেয়েছিলাম। আমার কাজগুলো বিদেশি ক্লায়েন্টেদের নিয়ে। সেজন্য আমি কোথায় বসে কাজ করছি, সেটা মুখ্য বিষয় না। আসল হলো সময়মতো কাজটা বুঝিয়ে দেয়া।'
গ্রামের জীবন সহজ এবং খরচও কম। শহরের চেয়ে গ্রামে যান্ত্রিকতা কম, চাহিদাও কম। তবে পরিচিত মানুষ বেশি হওয়ায় কর্মপরিবেশ তৈরি করাটা কিছুটা কঠিন। হিরোক বলেন, 'আমি মনে করি, যদি গ্রামে কাজের প্রতি একাগ্রতা তৈরি করেন এবং কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারেন, তাহলে গ্রামে বসেও অনেক কিছু করা সম্ভব। একই সঙ্গে এখানেও সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে হিরোক জানান, মেহেরপুরে চাকরি করার মতো খুব বেশি প্রতিষ্ঠান নেই। তাই তিনি নিজের ফ্রিল্যান্সিং প্রতিষ্ঠানটি আরও বড় করতে চান, যেখানে অনলাইন থেকে বা বিভিন্ন দেশের লোকবল না নিয়ে নিজের এলাকার লোকবল নিয়ে কাজ করতে চান। তিনি ফ্রিল্যান্সিংকে শিল্প পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, যেখানে অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থান হবে।